বাইপাস ও বিয়ারের ক্যান

বাইপাস ও বিয়ারের ক্যান
– বিশ্বদীপ মুখার্জী

 

 

অনুরোধ অগ্রাহ্য করা যায় না সব সময়ে। সৌভিকের অনুরোধ আমি এক বার অমান্য করেছি। ওর বিয়ের সময়। অতিরিক্ত ব্যস্ততার দরুণ যেতে পারিনি ওর বিয়েতে। অভিমান যে ওর হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য। দু’দিন আগে সে আমায় ফোন করে বলল – ‘এবার আমি কোনো বাহানা শুনবো না। তোকে আসতেই হবে, এটাই শেষ কথা। আর রিয়া কী ভাবছে বলতো? কেমন বন্ধু রে বাবা, বিয়ে হওয়া থেকে দর্শন নেই একবারও।’

না, এবার যেতেই হবে।
সৌভিক বলেছিল – ‘আমি বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে যাবো।’
আমি মানা করলাম।
‘দরকার হবে না। তুই আবার আসতে যাবি কেন? আমি পৌঁছে যাবো।’

কেলেঙ্কারিটা ঘটল বাসটা খারাপ হয় গিয়ে। ঠিক করার অনেক চেষ্টা করা হল, কিন্তু লাভ হল না। খানিক বাদে সহযাত্রীরা যে যার মত চলে গেল। শুধু রয়ে গেলাম আমি। লম্বা বাইপাস রাস্তা। এখান থেকে সৌভিকের বাড়ি নিদেনপক্ষেও দশ  কিলোমিটার তো হবেই। হেঁটে যাওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না। বেলা বাড়ার সাথেসাথে রৌদ্রের তাপ নিজের প্রকাণ্ড রূপ ধারণ করছে। রাস্তার দু’ধারে ক্ষেত। আশেপাশে কোনো গাছপালার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ রাস্তার ওপার থেকে একটা বাস আসতে দেখলাম। মনে প্রবল ইচ্ছে হল বাসটা ধরে ফেরত চলে যাই। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের ইচ্ছেকে দাবিয়ে দিলাম। সৌভিকের বিয়েতে যাইনি। এবার যদি তার ছেলের অন্নপ্রাশনেও না যাই, তাহলে সে কোনো দিন ক্ষমা করবে না আমায়। বন্ধুত্বের মাঝে চিড় ধরেই যাবে। সেটা আমি কখনোই হতে দিতে চাই না

বাসটা আমার সামনে দিয়ে চলে গেল। আমি লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম সে দিকে। ব্যাগটাকে কাঁধে নিয়ে বাইপাস ধরে এগিয়ে গেলাম। ভাবলাম, সৌভিককে ফোন করে ডেকেনি। ওর বাইক নিয়ে আসতে বেশি সময় লাগবে না। দুর্ভাগ্য যে আমার ছায়া হয়ে আমার সাথেই যাত্রা আরম্ভ করেছে, সেটা বুঝলাম যখন সৌভিকের ফোন লাগলো না। হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু দাঁড়ানোটাও দুর্বিসহ হয়ে উঠছিল। অগত্যা পুনরায় হাঁটা শুরু করতেই হল।

একনাগাড়ে পাঁচ মিনিট হাঁটার পর সম্পূর্ণ শরীর যেন অবসন্ন হয়ে উঠছিল। হাত-পা অসার। ক্ষণেকের জন্য বিরতি নিয়ে আবার যাত্রা পথে এগিয়ে যাওয়া। ঘামে সমস্ত শরীর গেছে ভিজে। গলা শুকনো কাঠের মত। হঠাৎ খেয়াল হল ব্যাগে একটা জলের বোতল আছে। আপাতত জল পান করে তৃষ্ণা থেকে মুক্তি তো পাই। শরীরে জল গেলে নাকি শক্তির সঞ্চার হয়। আমার শক্তির প্রয়োজন। মানসিক এবং শারীরিক। ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করার পর ক্ষণেকের জন্য হাত-পা ছুঁড়ে ক্রন্দন ভিন্ন আর কিছুই মাথায় আসেনি। জল প্রায় ফুটন্ত। যথাস্থানে জলের বোতলটা রেখে দিয়ে নিজের অসার দেহটাকে টানতে, টানতে এগিয়ে নিয়ে চললাম। মরুভূমিতে মরীচিকার মত দেখা দিলো খানিক দূর একটা বট বৃক্ষ। রাস্তার যেই ফুটে আমি ছিলাম, ঠিক সেই ফুটেই। আশ্চর্য ভাবে আমার শরীরে শক্তির সঞ্চার হল। পা দুটো যেন নিজে থেকেই তীব্র গতিতে ছুটে চলল সেই মরুভূমির মরীচিকার দিকে। বট বৃক্ষের দিকে যত এগোই, ততই যেন আমার হাঁটার গতি তীব্র হয়। এমন গতিতে এর আগে কোনো দিন হেঁটেছি কিনা মনে পড়ে না। কিন্তু একী? আমার সামনে থেকেও কেউ সেই বৃক্ষের দিকে সজোরে এগিয়ে আসছে বলে মনে হল আমার। আমি ভুল দেখছি না তো? না, ভুল আমি দেখছি না। আমার সামনে একটা লোক নিজের কাঁধে বড় কিছু একটা নিয়ে এগিয়ে আসছে বট বৃক্ষের দিকে। তার পাশে ছোট্টো একটা কন্যা।ধীরে ধীরে দুরত্ব কমলো আমাদের মধ্যে। আমার আগে সেই লোকটাই বট বৃক্ষের শীতল ছায়ার  নীচে উপস্থিত হল। বৃক্ষের তলায় স্থানের অভাব নেই। ঈষৎ দুরত্ব নিয়ে বসলাম আমি। মনে মনে ভাবছিলাম যে লোকটা কাঁধে এক প্রকাণ্ড বোঝা নিয়ে এতো দ্রুত গতিতে হাঁটল কী করে? দু’জনের পোশাক দেখে নিম্ন শ্রেণীর বলে মনে হল আমার। লোকটার বদনে এক ছেঁড়া গেঞ্জি এবং ময়লা লুঙ্গি। বয়স দেখে বোঝা মুশকিল। গরীবদের বয়স এমনিতেই একটু বেশি মনে হয়। তাও চল্লিশের কাছাকাছি বলে মনে হল। গায়ের রং কালো। এক মাথা রুক্ষ চুল। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি গোঁফ। মেয়েটার বয়স খুব জোর আট বছর। শ্যামল বর্ণ দেহ। রুক্ষ ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। দেহে ছেঁড়া ফ্রক। দেখে বোঝাই যায় সেই লোকটার কন্যা। আমার কৌতূহল হল লোকটার কাঁধে বৃহৎ বোঝাটা দেখে, যেটাকে সে ইতিমধ্যে মাটিতে নামিয়েছে। মাদুর ও কম্বলে পরিপাটি করে মোড়া একটা বৃহৎ বস্তু। লোকটার কাঁধে এক গামছা, যেটা দিয়ে নিজের মুখ থেকে ঘাম মুছতে, মুছতে সেই মেয়েটিকে বলল – ‘আর বিশী দূর না। চলেই আইলাম। ‘

মেয়েটি শূন্য নেত্রে চেয়ে রইল সেই লোকটার দিকে।
‘নে, তুইও ঘাম মুছিয়া ফেল।’ গামছাটা মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলো।

আমার মধ্যে এক বড় রকম দোষ আছে। বেশিক্ষণ নিজের কৌতূহল দাবিয়ে রাখতে পারি না। এবারও পারলাম না। লোকটাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম – ‘দাদা , মাদুরে মোড়া এই বস্তুটি কী?’
লোকটা চমকে তাকালো আমার দিকে। এতক্ষণ হয়তো আমাকে লক্ষ্য করেনি সে। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে খানিক চেয়ে সে বলল- ‘আজ্ঞে, ইটা বস্তু নয় বটে।’
‘তবে কী?’ আমার কৌতূহল আরো বৃদ্ধি পেল।
বাচ্চা মেয়েটির দিকে একটা আঙ্গুল দেখিয়ে সে বলল- ‘এর মা বটে।’
শুনে আমি আঁৎকে উঠলাম। লোকটা বলে কী? এই ছোট্টো মেয়েটির মা?
‘হাসপাতাল থিকা আইসছি, আজ্ঞে। আজ ভুরে মুরে গেল।’
আমি হাঁ হয় ওর কথা শুনছি। কী বিকট যন্ত্রণা এদের, সেটা ভেবেই সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল। তাহলে কি লোকটা হাসপাতাল থেকে এই মৃতদেহটা কাঁধে করে নিয়ে আসছে? আমি প্রায় নির্বাক। লোকটা কি আমার মনের কথাটা শুনতে পেল? বলল – ‘হাসপাতালে একটা ভ্যান ছিল। উনেক টকা চাইলো। টকা আর কুথায়? তাই কাঁধে করে……।’ কথা শেষ করতে পারলো না সে। হয়তো গলা ভারী হয় আসছিল।
আমি হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে রইলাম তার দিকে। আশ্চর্য ঘটনা। এরকম ঘটনা সচরাচর চোখে পড়ে না। লোকটার কী আশ্চর্য ক্ষমতা? দুঃখের পাহাড় নেমে এসেছে তাদের কাঁধে, কিন্তু তবুও কাঁধ এখনও বলিষ্ঠ। লোকটার দিকে তাকিয়ে আমি নিজের ওপর লজ্জা বোধ করলাম। আমার পিঠে একটা ছোটো ব্যাগ। এই সাংঘাতিক গরমে ব্যাগের ভারটা যেন কোনো পর্বতের ভারের মত প্রকাণ্ড মনে হচ্ছে আমার। দীনতা মনুষ্যের সহ্য ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় শুনেছিলাম। আজ দেখেও নিলাম। হঠাৎ বাচ্চা মেয়েটির কন্ঠস্বরে আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম। নিজের পিতাকে সে বলছে- ‘বাবু, জল খাইবো।’

‘সে কি রা? তিষ্টা পেলো নাকি?’
মেয়েটি ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।
‘উফঃ! এখুন জল কুথায় পাই বল দেকিনি? ইকটু বাদেই তো বাড়ি পৌঁছেছে যাব।’
‘জল খাবো, বাবু।’ কাঁদো কাঁদো গলায় পুনঃরায় নিজের পিতাকে বলল সে। তৃষ্ণায় দু’চোখ সজল হয়ে উঠেছিল তার।
তৃষ্ণা কতটা কষ্টকর সেটা প্রত্যেকেই জানে। তৃষ্ণার্ত আমিও। কিন্তু যে জল আমার কাছে আছে, তাতে বিন্দু মাত্র তৃষ্ণা নিবারণ হবে না আমার সেটা বেশ ভালোই জানি। আমরা ফ্রিজের জল পান করে অভ্যস্ত। কিন্তু এরা? এরা তো এহেন জল দিয়েই নিজেদের তৃষ্ণা মেটায়। ফ্রিজের জল পাবে কোত্থেকে এরা। তাহলে কি আমার বোতলে যে ফুটন্ত প্রায় জলটা আছে, তাতে এই মেয়েটির তৃষ্ণা মিটবে? মেয়েটি নিরন্তর নিজের পিতাকে বিরক্ত করে যাচ্ছে জলের জন্য।
‘জ্বালাস নাতো। একে তো তুর মা সংসারটাকে জ্বালিয়ে চলে গেলো। এবার তুই জ্বালাস না। এবার মুনে হয় আমাকেেও মুরতে হবে।’ নিজের মেয়েকে বেশ ঝাঁঝিয়়ে কথাগুলো বলল লোকটা।
খারাপ লাগছিল আমার। বট বৃক্ষের শীতল ছায়াতে যেন দম বন্ধ হয় আসছিল আমার। নিজেকে সংযমে রেখে ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করে মেয়েটিকে দিলাম। ইতস্তত করলো প্রথমে। তাকালো নিজের পিতার দিকে। লোকটা করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলো শুধু।
‘নাও, জল আছে।’ মেয়েটিকে বললাম। তার হাতে বোতলটা ধরিয়ে দিলাম।

গরম জলে তৃষ্ণা নিবারণ হয় না সেটা জানা কথা। প্রায় পুরো বোতল রিক্ত করার পরেও মেয়েটির তৃষ্ণা মেটেনি সেটা বুঝলাম খানিক বাদেই।

আমাকে বোতল ফেরত দেওয়ার পরেই লোকটা উঠে দাঁড়ালো।
‘চলি আজ্ঞে। দেরি হুই যাবে। চল রে।

আমার মনটা অজান্তেই ছটফট করে উঠল। কিছু সাহায্য করতে চাইছিলাম তাদের। কিন্তু কেমন সাহায্য? অর্থ দিয়ে নাকি সঙ্গ দিয়ে? সঙ্গ দেওয়ার সময় আমার কাছে নেই। তাই অর্থ দিয়েই সাহায্য করবো নিশ্চয় করলাম। বলতে দ্বিধা নেই যে সংকোচ হচ্ছিল। শব্দের অভাব বোধ করছিলাম। পার্সে সর্বসাকুল্যে হয়তো দু’শত টাকা হবে। একশত টাকার একটা নোট বার করে লোকটার দিকে বাড়িয়ে বললাম- ‘এটা রাখো। কাজে দেবে।’
লোকটা ততক্ষণে নিজের মৃত স্ত্রীর দেহকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়েছে। আমার দিকে চেয়ে বলল- ‘না আজ্ঞে, টাকা লিবো না। আপনি ভগুবান মানুষ। মেয়েটিকে জল দিয়া বাঁচাইলেন। আপনিগো থিকা টাকা লিয়া আমি পাপ করবো না।’
‘পাপ কিসের? কথা যদি পাপের আর পূণ্যের হয়, তাহলে পাপ তো আমি করছি। আপনাকে এতো বড় একটা সংকটে দেখেও মাত্র এই কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করছি।’
আমি আর কথা বাড়ালাম না। এই সময় মনুষ্যত্বের বিষয়ে ভাষণ দেওয়া যুক্তিকর হতো না। জোর করেই লোকটার হাতে গুঁজে দিলাম সেই নোটটা। দশ টাকার দু’টো নোট মেয়েটির হাতে দিয়ে বললাম- ‘ঠান্ডা কিছু খেয়ে নিস।’

নিজের গৃহের দিকে এগিয়ে গেল তারা। এর পরেই যা দেখলাম, সেটা আমার জীবনের চরম অভিজ্ঞতা। তৃষ্ণা মানুষকে দিয়ে কী না করায়? রাস্তার ওফুট দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল একটা গাড়ি। উচ্চ ধ্বনিতে গান কানের পোকা নাড়িয়ে দিলো। গাড়ির এক খোলা জানালা থেকে তীর বেগে বেরিয়ে এলো রিক্ত এক বিয়ারের ক্যান। ক্যানটা মেয়েটির পায়ের কাছে এসে হোঁচট খেয়ে থেমে গেলো। ঝুঁকে সেই রিক্ত ক্যানকে ওঠালো সে। ক্যানের গায়ে এখনও বিন্দু বিন্দু জলকণা লেগে ছিল। ঠান্ডা, শীতল জল কণা। তৃপ্তি সহকারে সেই জল কণা চাটতে চাটতে মেয়েটি নিজের বাবুর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো। আমি শুধু মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখতে থাকলাম।

সমাপ্ত ।

Loading

Leave A Comment